সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

জীবনানন্দ দাশ-এর তিনটি ভালো লাগা কবিতা

ছোটবেলা থেকেই জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতার রীতিমত অন্ধ ভক্ত ছিলাম। "হাজার বছর ধরে আমি পথ........" -এর হাত ধরেই এই ভাল লাগার শুরু। কবিতাটি কার না ভালো লাগে! এরকম অমর কবিতার আবেদন তো কখনও ফুরাবার নয়। সেই সূত্র ধরেই আমার প্রিয় জীবনানন্দ দাশ-এর তিনটি কবিতা আপনাদের সাথে উপভোগ করতে চাচ্ছি। ভালো লাগলে জানাবেন।

তার আগে চলুন জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে কিছু জেনে নিই। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে জীবনানন্দ দাশ (বরিশাল, অক্টোবর ২২, ১৯৫৪) জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খৃস্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। কারন জীবদ্দশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করে উঠতে পারেন নি।



জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশের বাবার নাম সত্যানন্দ দাশ এবং মায়ের নাম কুসুমকুমারী দাশ। সত্যানন্দ দাশ (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন স্কুল শিক্ষক, পত্রিকা সম্পাদক এবং প্রবন্ধকার। একান্নবর্তী পরিবারের ব্যস্ত গৃহিনী কুসুমকুমারী দাশ (১৮৮২-১৯৪৮) কবিতা লিখতেন। জীবনানন্দ ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, তাঁর ছোট ভাই অশোকানন্দ এবং বোন সুচরিতা। বাড়ীতে মা-বাবার কাছে তার শিক্ষার হাতে-খড়ি। বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সূত্রপাত হয়। এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি ব্রজমোহন কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়াশুনা করেন এবং বি,এ, পাস করেন। । ১৯২১ খৃস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে শ্রীমতী লাবণ্য গুহকে বিবাহ করেন। তাঁদের দুটি সন্তান। ১৯৩১ সালে কন্যা শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী এবং ১৯৩৮ সালে পুত্র শ্রী সমরানন্দের জন্ম হয়।

১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাকে উদ্ধার করে। তাকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশ এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধেই পশ্চিম বঙ্গ-এর মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন যদিও এতে চিকিৎসার তেমন উন্নতি কিছু হয় নি। জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১ টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয় আত্মহত্যাস্পৃহা ছিল দুর্ঘটনার মূল কারণ। ত চলুন কবিতাগুলি আর একবার চেখে দেখা যাক।

১. অদ্ভুত আঁধার এক-জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুনার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।


২. তোমায় আমি-জীবনানন্দ দাশ

তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।
নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।
তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।
জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।



৩. বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‌‌‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।


তথ্যসূত্র:
১. ক্লিনটন বি সিলি লিখিত আ পোয়েট আপার্ট।
২. উইকিপিডিয়া।
৩. হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত আধুনিক বাঙলা কবিতা
৪. জীবনানন্দের মৃত্যু - ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
৫. কবিতার বই।

1 টি মন্তব্য: