শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০০৯

পোট্রেট মডেল

১.
ছোটবেলা থেকেই আকাঁআকির প্রতি ছিল অবাধ্য্ দূর্বলতা। যদিও শিল্পকর্ম বলতে যা বুঝায় তার ধারকাছ দিয়েও ওগুলো যেত না। “কি সব ছাই-পাশ….”, “অনর্থক টাকা নষ্ট”…, এধরনের অনেক শাণিত প্রশংসা শুনলেও আকাঁআকির প্রতি তীব্র অনুরাগের অতটুকু পরিবর্তন হয়নি আমার কখনও।

আমি তখন শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার আর্ট গুরু অরবিন্দু দাশগুপ্ত এক সন্ধ্যায় ফোন করে বললেন আগামী পরশু একটা Group Exhibition আছে, তুমি একটা পোর্ট্রেট একেঁ কাল বিকেলের মধ্যে যেকোন ভাবেই হোক জমা দাও। অবজ্ঞা কর না। গুরু আদেশ শিরোধার্য। পোট্রেট আকঁব, কিন্তু মডেল তো লাগবে! আশেপাশে তো দেখতে পাচ্ছি না। ঐদিন রাতে নিকট প্রতিবেশী দীপা আন্টি বেড়াতে আসলেন উনার দু-জমজ বাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায়। সুমিত আর অমিত। বয়স ৮। তাদেরকে দেখামাত্রই পরিকল্পনা করতে দেরি করলাম না। ছবির নামও ঠিক করে নিলাম। “Dream”. আন্টিকে বলা মাত্রই অত্যু উৎসাহে সায় দিলেন। আমি তাদেরকে আমার রুমে নিয়ে আসলাম।


সুমিত ভায়া, তুমি টেবিলে মাথাটা টেবিলে হেলান দিয়ে বস, আর অমিত ভায়া, তুমি বড়দার কাধেঁ হাত দিয়ে আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকো, কেমন!

"দাদাভাইয়া, হেলান কি?" - অমিতের কৌতুহলী প্রশ্ন। যন্ত্রনার শুরুই যে তখন, আগে বুঝতে পারিনি।

২.
আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে স্কেচ মাধ্যম ব্যবহার করার সুবিধা হল ওয়াটার কালার আর ওয়েল পেইন্টিংয়ের মত এখানে অসংখ্য সরঞ্জমাদি (ড্রয়িং ম্যাটারিয়াল) নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হয় না। শুধুমাত্র একটা মোটামুটি মানের ভাল পেন্সিল এবং একটা স্কেচশীট হলেই যথেষ্ট। তাছাড়া কোথাও অপ্রত্যাশিত কোন পোচ্ পরে গেলে, সেটা আবার ইরেজার দিয়ে তৎক্ষনাৎ মুছেও ফেলা যায়। যা হোক একটা গ্রুপ এক্সিবিশানের জন্য পোট্রেট আঁকার কাজ হাতে নিয়েছিলাম আমার আর্ট গুরু অরবিন্দু দাশগুপ্ত আর্জিক্রমে। কালই জমা দিতে হবে। ভাগ্যক্রমে মডেলও জোগাড় হয়ে গেছে। এখন শুধু আঁকার পালা।

আমার মডেল সুমিত আর অমিতের চোখেমুখে প্রবল কৌতুহলের ছাপ। ড্রয়িং ম্যাটারিয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে আমি কি করতে যাচ্ছি তাদের নিয়ে।

“নাড়াচাড়া করে না ভাইয়া - তাহলে তোমাদের ছবি ভালো হবে না যে, পঁচা হয়ে যাবে খুব।” - আমি নরম সুরে বললাম।

আউটলাইনটা শেষ করার পর চোখের টোনটাও অনেকটা এগিয়ে নিয়ে এসেছি। তখন থেকেই তাদের মধ্যে টুকটাক খুনসুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল।

“দাদাভাইয়া, দেখেন দেখেন অমিত আমার পিঠে চিমটি কাটছে”-বলেই বিচারের অপেক্ষা না করে সে অমিতের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিল। আচমকা অপ্রত্যাশিত চড় খেয়ে আগুনঝরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সুমিতও তার দুহাতের নখ ব্যবহার করে সর্বশক্তি দিয়ে অমিতকে খামছে দিল। কিছুক্ষন পর অনবরত কিল ঘুষি চলতে লাগল। একজন আরেকজনকে সজোরে খামচাতে লাগল। প্রায় রক্তারক্তি অবস্থা। পরিস্তিতি বেগতিক দেখে আমি তাড়াতাড়ি হাতের স্কেচশীটটা ডেস্কে রেখে তাদের দ্বন্দযুদ্ধ রুখতে উঠে গেলাম। আমি দুজনকেই হালকা ধমক দিয়ে আবার আগের ভঙ্গিতে বসানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার কাছ থেকে উপযুক্ত বিচার না পেয়েই বোধহয় অমিত ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে তীব্র গলায় বিচারের দাবী করল। কিছুক্ষন পরে দীপা আন্টি অমিতকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার ডেস্কে নিয়ে আসলেন এবং বসিয়ে দিয়ে গেলেন। মায়ের শাসানিতে কিছুটা শান্ত হয়ে সুমিত-অমিত আবার আগের মত পোজ্ দিয়ে বসল ডেস্কের উপর।

রাত আটটা বাজে, কাল সকালে ৯টার মধ্যেই পোর্ট্রেটটা জমা করতে হবে-এই টেনশন মাথায় নিয়ে আবার নব উদ্যমে স্কেচটা করা শুরু করতে লাগলাম।

পেন্সিল আবার শুধু হাতে ধরতেই সুমিত কাচুমুচু ভঙ্গিতে বলে উঠল, “দাদাভাইয়া, বাথরুম পেয়েছে”। আমার চেহারা দেখেই মনে হয় সে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে বাথরুমের দিকে ছুটে গেল। সুযোগ পেয়ে অমিতও একটা অজুহাত দেখিয়ে টিভি দেখতে চলে গেল। পরে আন্টিকে ব্যবহার করে তাদেরকে আবার ডেস্কে নিয়ে এসে বসালাম।

কিছুক্ষন পরে ওরা আরও কয়েক’দফা মারামারি-কাটাকাটি করল। সময়ের কথা বিবেচনা করে আমি আর তাদের উপর পূর্ণ ভরসায় না থেকে কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তবের মিশেলে তাদের পোর্ট্রেটটা মোটামুটি শেষ করে নিয়ে আসতে থাকলাম।

তখনি স্কেচবুক থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি অমিত আর তার জায়গায় নেই। হঠাৎ টের পেলাম সে পেছন থেকে আমার রং মেশানো জগভর্তি পানি আমার গায়ের উপর ঢেলে দিল। সেই রং মেশানো পানিতে আমার পুরো স্কেচশীটটাও নষ্ট হয়ে গেল। পরে ছোট ভাইয়ের কান্ডকারখানা অনুসরন করে সুমিতও নির্বিকার ভঙ্গিতে গ্লাসভর্তি পানি আমার মাথার উপর ঢেলে দিয়ে দাতঁ কেলিয়ে হাসতে লাগল দুজনেই। আমার ভ্রম্মতালু তখন চরমে। আমি আর কালক্ষেপন না করে, ডান বাম না ভেবে, দাতঁ কড়মড় করে দুইটাকে শার্টের কলার ধরে আন্টির কাছে নিয়ে আসলাম। আর বললাম-“আন্টি আরেকটু কাজ বাকি আছে, ওটুকু আমি তাদের ছাড়াই করে ফেলতে পারব।”

পরে ওরা চলে যাওয়ার পর রাত জেগে ভেজা স্কেচশীটটা দেখে দেখে হুবুহু আরেকটা কপি আকঁলাম। লোডশেডিং আর মশার কামড় তখন আমাকে সাবক্ষনিক সঙ্গ দিয়ে চলেছিল।

শেষ রাতের দিকে অরবিন্দু স্যারের ফোন। “কি তোমার পোর্ট্রেটের কাজ হয়ে গেছে তো? মডেল কে ছিল?”

“হ্যাঁ, প্রায় হয়ে এসেছে, মডেল ছিল দুটি শিশু, সুমিত ও অমিত।”

“খুব ভাল সাবজেক্ট নিয়েছো, কাজটা নিশ্চয়ই ভাল হবে। শোন, নিষ্পাপ শিশুরা হচ্ছে স্বর্গ থেকে আসা সাক্ষাত্ দেবদূত। তাদের সাথে কাজ করতেও আনন্দ। শিশুদের সাবজেক্ট করে আকাঁ ছবিতে তাদের নিষ্পাপ ভাবটা যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারাটাই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের কাজ।”

তখন মনে মনে বললাম,
“তাদের ভয়াবহ নির্মমতায় আমার স্কেচে তাদের নিষ্পাপ ভাবটা ফুটে আসছে কিনা জানি না - তবে এত বেশি নিষ্পাপদের (?!?!) নিয়ে যে আমি আর কোন কাজ করব না - তখনই ঠিক করে নিলাম।”

[বি.দ্র.:
১. অমিত আর সুমিত দীপা আন্টির সাথে সেই Exhibition দেখতে এসেছিল। সুমিত-অমিত আমার ছবিটি দেখে বলেছিল, “দাদাভাইয়া আবার কবে আকঁবে আমাদের?”
২. পরে পোর্ট্রেট ক্যাটাগরিতে ২য় পুরস্কার প্রাপ্ত এ ছবিটির পুরস্কারের টাকার একটা অংশ দিয়ে জলরং ম্যাটারিয়াল কিনে দিয়েছিলাম তাদের দুজনকেই।]


"Dream"- (সুমিত-অমিত), মাধ্যম: পেন্সিল স্কেচ।

=======================

[সাথে আরও কিছু “ছাই-পাশ” এর প্রমাণকপি না দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, এই আশা রাখি।]

----------------------
[এই সূত্র ধরে আমার কিছু তথাকথিত “ছাই-পাশ” এর প্রমাণকপি না দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, এই আশা রাখি।]
বাউল ও তার প্রেক্ষাপট
বাউল ও তার প্রেক্ষাপট

এইজ ডিফরেন্স
এইজ ডিফরেন্স

পতাকা এবং তার প্রতিচ্ছবি
পতাকা এবং তার প্রতিচ্ছবি

বর্ষা
বর্ষা

স্টিললাইফ
স্টিললাইফ

রুরাল লাইফ
রুরাল লাইফ


দেবী


রিপন
৩ অক্টোবর, ২০০৯
ওন্টারিও, কানাডা।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

Trespass

Open up the walls of my cottage
Let me freedom with the joy.
Open up the darkness of deep jungle,
Let me explore with the wild.
Open up the horizon's chest of ocean,
Let me enjoy with the mystery.
Open up the cave of enormous mountains,
Let me sleep with calm.


Open up the bond of my relations,
Let me be alone with myself.
Open up the complexity of livings,
Let me test the mundane with independence.
Open up the tomb of maternity,
Let me play with my birth,
Open up the seven sky of yours,
Let me trespass into the heaven of mine!
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

আমার প্রথম তান্দুরী রন্ধন

রান্না ব্যাপারটাকে আমি শিল্পের পর্যায়ে না নিয়ে যেতে পারলেও, সেই রান্না আমি মোটামোটি স্বাভাবিক জীবনধারনের উপযোগি করে তুলে ফেলতে পারি। এ দেশে (কানাডা) রন্ধনকর্ম-টা নারী-পুরুষের সীমারেখায় আটকানো নয়। এখানে বিশাল বাজারের অসংখ্য টকিটাকি, হাবিজাবি জিনিস জোড়াতালি দিয়ে লাগিয়ে খাওয়ার উপোযুগি কিছু একটা নিমিষেই তৈরি করে ফেলা যায়। যার জন্য রসনাবিলাসে কালক্ষেপন করার মতন নিম্নবিলাসি মানসিকতা এদেশের স্হূলকায়দেরও নেই।

আমি মোটামোটি সকল কাজে “অকর্মার ঢেঁকি” বিশেষনে বিশেষায়িত হলেও, আমার রন্ধনশৈলীতে এই উপাধি কেউ দিয়ে বসলে, আমার ভ্রম্মতালুর রক্তচলাচলে প্রবল প্রাণসঞ্চার হয়। এইত সেদিন, আমার তৈরি করা টমেটোর চাটনি চেটে পুটে খেয়ে বলে কিনা -“পুঁড়া পুঁড়া লাগছে”(আমি নাকি কর্মে থাকলে অন্ন্যমনস্ক হয়ে যাই বলে প্রায়ই খাবার পুড়িঁয়া ফেলি)…………………আরে বেটা, তুই…………(সেন্সরড!)…………………ভা
গ্যিস, অল্পের জন্য খুনোখুনি হয়ে যায় নি।

রান্না-বান্নায় ভাল করার একটা অনাবশক শর্ত মনে হয় “লেগে থাকা” জাতীয় কিছু। এক্ষেত্রে আমি জন্মগতভাবে ধৈযহীন হওয়ার কারনেই বোধহয় অতি আগুনে ঝটপট রান্না করার শটর্কাট পধতি তৈরি করার অভিপ্রায়ে অসংখ্যবার শারীরিক সার্জারীর মধ্য দিয়ে গিয়েছি। যার কিছু স্হায়ী স্মৃতিচিহ্ণ এখনও বয়ে বেড়াছি, আষ্টেপৃষ্টে।


বস্তুত, আইটেমে ভেরিয়েশান আনার ব্যাপারে কিছুটা কনজারভেটিভ হলেও, এক্সপেরিমেন্টাল রান্না-বান্নার ব্যাপারে আমার আগ্রহের কোনো কমতি নেই। পৃথিবীর অনেকেই জানে না, এরকম অনেক গুরুত্বপুণ ইনফরমেশন বিশ্ব রন্ধনীয় জ্ঞানকোষে সফল সংযোজন করতে পেরে আমি প্রায়শই একধরনের আত্ববিগলন অনুভব করি, যদিও নিকটমহলের সুচ-ফুটানো টিটকারীর জন্য সেই আত্ববিগলন কখনই পুর্নতা লাভ করেনি।

বৈদেশীও উপকরনে দেশিও রেসিপি বানানোর বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিলেও কয়েকটিতে যে যারপরনাই প্রশংসিত(??) হয়েছি, তার কয়েকটি না বললেই নয়। এই ধরেন, আমার প্রথম তান্ধুরী রান্নার গল্পটা। গল্পের শুরুটা এরকম………………এ রে, উঠতে হবে……………চুলা থেকে কেমন জানি পুঁড়া পুঁড়া গন্ধ আসছে।

রিপন,
ওন্টারিও, কানাডা।
২৯ আগস্ট, ২০০৯

আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......