শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১০

গল্প: ভালবাসায় লোডশেডিং...........

গভীর রাত। ছাদের দক্ষিন কোনায় ছোট্ট ব্যালকনীর দেয়ালের উপর হেলান দিয়ে বসে আছে আবীর। অজস্র তারা উঠেছে আজ। আবীর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের তারার দিকে। এ এক অদ্ভুত ভাল লাগা। তবে এক বিশেষ কারনে আবীরের মনে আজ অদ্ভুত শিহরন বয়ে যাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি লোহিতকনিকা যেন তীব্র উত্তেজিত হয়ে রক্তনালিকা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যে মেয়েটার সাথে গত ছয়মাস ধরে ফেসবুকে/ফোনে চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে, সেই মেয়ের সাথে কালই প্রথম দেখা করতে যাচ্ছে আবীর। তারা গুলোর ফাঁক দিয়ে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। হিমেল বাতাসের আলতো ধাক্কা লাগছে আবীরের গায়ে। কিছু একটা ভাবতে যাচ্ছিল আবীর এমনসময় ফোনটা তার স্বভাবজাত স্বরে বেজে উঠল।
“কি করছ?”
“মাধবী”?
“হমম”।
“মাধবী জান, প্রবল আনন্দে আমার শরীর আজ কাঁপছে”।
“হুমম, এটাই স্বাভাবিক। আমার যে খুব ভয় ভয়ও করছে”!
“কেন”?
“তুমি যদি আমাকে দেখে পছন্দ না কর। আমি যদি তোমার মনের মত না হই”!
“এভাবে বল না, মাধবী। তোমাকে নিয়েই আমার সকল স্বপ্ন, আমার সকল ভাললাগা। এতদিন তিল তিল করে যে স্বপ্নের বাসর গড়েছি তোমাকে নিয়ে সে বাসর অবিনশ্বর, সেটা কি ভেঙ্গে ফেলা যায়? আমার সকল অস্বিত্ব, আমার সত্ত্বা তোমাকে ঘিরে, তোমাকে নিয়েই আমার পূর্ণতা।”
“এত ভালবাস আমাকে”?
“হুমম, এত। বিশ্বাস হয় না?”
“হুমম, হয়”।
“তুমি কাল কি পড়ে আসবে”?
“নীল টি-শার্ট, সাথে কালো প্যান্ট”।
“আর আমি?”
“তুমি সবুজ শাড়ী পড়বে, মাথায় থাকবে রজনীগন্ধা, আর হাতে বেনারসি চুড়ি। ওকে?”
“ওকে, Done”।
“সোনা, একটু ছাদে উঠনা, প্লিজ। দেখনা কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজ। উঠনা একটু”।
“এই এখন না, এত রাতে ছাদে উঠলে বাবা সন্দেহ করবে”।
“প্লিজজজজজজজ”।
“ওহ, উঠছি বাবা। তুমি না, একটা পাগল”।
“হুমম, পাগল, সে তো তোমার জন্যই”।


অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলছিল আবীর মাধবীর সাথে। তাই ঘুম থেকে এত দেরি করে উঠা। এখন বাজে দুইটা। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে চুলে হালকা জেল দিয়ে গায়ে পারফিউম মাখিয়ে বেরিয়ে পড়ল আবীর। সানগ্লাসটা হাতে নিল। মাধবীর পাঁচটার সময় শাহবাগের মোড়ে থাকার কথা। এখন বাজে তিনটা। প্রবল উত্তেজনা তাড়িত করছে আজ আবীরের মনে। অনিচ্ছাকৃতভাবে এত আগে বেরিয়ে পড়ার এটাই হয়তো কারন। “ফ্লোরা এন্ড ফাউনা” দোকান থেকে এক তোড়া লাল গোলাপ কিনল আবীর। হাটার ফাঁকে ফুলের সুবাস নিল। আহ। শাহবাগের মোড়ের কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে রইল আবীর। প্রতিক্ষার প্রতিটি মুহুর্ত যেন এক একটি বছর মনে হচ্ছে আবীরের কাছে আজ। কিছুক্ষন এদিক ওদিক হাটাহাটি কলল আবীর। মোড়ের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আকাশের অবস্থা ভাল না। কিছুক্ষের মধ্যে ঝড় নামবে।

অবশেষে এল সেই প্রতিক্ষিত মুহুর্ত। যে মুহুর্তটির জন্য মনের গহীনে ভালবাসা দিয়ে বুনেছিল এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিক্ষার প্রহর। যার জন্য মনের অজান্তে অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিল আবীর। রাস্তার অপাশে রিকশাটি থামল। রিকশার হুড খুলে অল্প তাকাল মেয়েটি। সবুজ শাড়িতে ওকে একটি সবুজ পরীর মত লাগছে দেখতে। কপালে লাল টিপ। মাথায় রজনীগন্ধার ডালি। বিধাতা কি মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়েছিল এই নারীমূর্তি। আবীরের প্রবল উত্তেজনায় হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল।
মাধবী হাত দিয়ে ইশারা করল, “এই, রিকশায় উঠো, ঝড় আসছে”।
কথা শুনে আবীর সম্বিত ফিরে পেল। আবীর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। ধেয়ে বৃষ্টি আসছে কিছুক্ষনের মধ্যেই।
আবীর তাড়াতাড়ি রিকশায় কাছাকাছি গেল।
“কেমন আছ, তুমি?”-মাধবী জানতে চাইল।
“হুমম, ভাল, তুমি?”
“খুব”।
“এখন রিকশায় উঠো, প্লিজ। বৃষ্টি আসছে এক্ষুনি”।
আবীর রিকশায় উঠল। আবীরের গা এই ঝড়ো বাতাসেও ঘামছে। এক অদ্ভুত উত্তেজনায় সে কোন কথা খুজে পাচ্ছে না। তার গলা তোকায় জানি আটকে যাচ্ছে বারবার। মাধবীও কোন এক রহস্যজনক কারনে তার সহজাত কথার ফুলঝুরি হারিয়ে ফেলেছে আজ। যে মেয়েটি রাতের পর রাত, ঘন্টার পর ঘন্টা এই ছেলেটার সাথে কথা বলে যেত ক্লান্তিহীনভাবে, সেও আজ কোন বাক্য সাজাতে পারছে না বলার জন্য। আসার আগেও অনেক কথা সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল দেখা হওয়ার পর বলবে বলে। এখন সব ভুলে গেছে। কিছুই আর মনে করতে পারছে না। অঝোড় ধারায় বৃষ্টি নামল। রিকশা থামাল ওরা। আবীর আঁচলচাঁপা দিয়ে মাধবীকে নিয়ে রিকশা থেকে নেমে একটি আম গাছের নিচে গিয়ে দাড়াল। দুজনেই এখনও চুপচাপ। মাধবীই নীরবতা ভাঙ্গল প্রথম।
“এ্যাই, বৃষ্টিতে ভিজবে”?
“হুমম”
দুজনেই ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল তখন।
“কিছু বলছ না যে?”
“কি বলব”?
প্রশ্নটা করতে গিয়ে আবীর মাধবীর দিকে তাকাল। সবুজ শাড়িতে মাধবীর সারা শরীর লেপ্টে আছে বৃষ্টির পানিতে। কপালের লাল টিপটি অনেকটা সরে পড়েছে কপালের মধ্যস্থান থেকে। দেখতে কি অর্পুবই না লাগছে মেয়েটিকে। মানুষ এত অপরূপ সুন্দর হয় কি করে? একেই কি অসহ্য সুন্দর বলা হয়? যা দেখে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ সরিয়ে ফেলতে হয়।
আবার কিছুক্ষন চুপচাপ।
একটু পর আবীর ধরা গলায় বলল, “এ্যাই, তোমার হাতটা একটু ধরতে দিবে?”
মাধবী নীরবে এগিয়ে দিল তার হাতটি। মাধবীর হাতে হাত রাখল আবীর। এই কোমল ছোঁয়া আবীরের পুরো শরীরকে অদ্ভতভাবে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। মাধবীর আঙ্গুলের খাঁজে খাঁজে আঙ্গল মিলিয়ে আবীর ওর সিক্ত হাতকে শক্ত করে ধরে থাকল। মাধবী আলতো করে আবীরের কাঁধে মাথা রাখল। দুজনেই দুর আকাশ পানে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। আকাশের কালো মেঘ আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে দিগন্ত সীমানায়।
মাধবী হঠাৎ তীব্র আবেগে বলে উঠল, “প্লিজ, কথা দাও, কখনও ছেড়ে যাবে না আমাকে? তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না আবীর।”

“না, যাব না”। আবীর মাধবীর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মাধবীও তাই। দুজনের চোখে চোখ। মাধবীর গভীর ঘনকালো চোখ দুটো যেন আরও দূর্বল করে দিচ্ছিল আবীরকে।

আবীরের চোখে অশ্রু। স্বর্গীয় আনন্দের অশ্রু। বৃষ্টির পানির সাথে আবীরের অশ্রু মিশে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে না। আবীর মাধবীর ভেজা কপালে চুমু খেল। আবীর মনে মনে ভাবল, “এত সুখ কি তার কপালে সইবে”? আবীর এক হাত দিয়ে মাধবীর ভেজা শরীর তার শরীরের সাথে চেপে ধরল। দুজন মুখোমুখি। আবীর ধীরে ধীরে তার তপ্ত ঠোঁটটি মাধবীর রক্তিম ঠোঁটের দিকে এগিয়ে নিতে থাকল। মাধবীর গরম নিশ্বাস স্পস্ট টের পাচ্ছে আবীর। দুটি শরীর, দুটি মন যেন এক হয়ে মিশে যাচ্ছে ভালবাসার অন্তহীন গভীরতায়।

এক বছর পর।
“আবীর, তোমার মনে আছে? ঠিক এক বছর আগে, ঠিক এই এখানটায় আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। “
“মনে আছে”।
“আর আজ আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি ঠিক এখানটায় এসেই। আমাদের ভালবাসার চূড়ান্ত রূপ দিতে যাচ্ছি আজ”।
“হুমম, আবীর অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। কিছুক্ষন পর বলল,
“ওইদিনের মত আজও তাই তোমাকে সবুজ শাড়ি পরে আসতে বলেছি, আর চুলে রজনীগন্ধা”।
মাধবী ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলল, “তুমিও তাই”।
“হুমম”।
“এ্যাঁই, আজও আমার ওইদিনের মত খুব ভয় ভয় করছে”, মাধবী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।
“কেন সোনা”?
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, বাবা ঠিকই আমাদের খুজে বের করে নিবে। কাল পালিয়ে আসার আগমুহুর্তে কেমন করে তাকাচ্ছিলেন বাবা। বাবা, আমার জন্য পারেন না, এমন কোন কাজ নেই আবীর। খুব ভয় করছে আমার, আবীর। এখানে যদি বাবা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আসেন। তোমাকে যদি ওরা কিছু করে ফেলে। তোমার যদি কিছু হয়, আমি বাঁচব না। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে, আবীর”।
আবীর জড়িয়ে ধরল মাধবীকে, “ভেব না জান, কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে, ভরসা রাখ, লক্ষিটি”।

হঠাৎ ভোঁ ভোঁ করে কেঁদে উঠল মাধবী। আবীর আরও জড়িয়ে ধরল মাধবীকে। এমন সময় ভরাট স্বর শুনে চমকে উঠল মাধবী।
“তুই ই আমার মেয়েকে…..। এই ধর”।
পেছনে ফিরে তাকিয়ে মাধবীর পিলে চমকে উঠল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। গলার স্বর আটকে যেতে থাকল। সামনে বাবা দাড়িয়ে। সাথে তার সসস্ত্র গুন্ডাদল।
আবীর করুন চোখে মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। আসন্ন পরিণতি মোকাবিলায় শক্তি অর্জনের চেষ্টা করতে লাগল আবীর মুহুর্তেই। মাধবী আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকল আবীরকে। মাধবীর বাবা এগিয়ে আসতে লাগল তীব্র বেগে তার সসস্ত্র বাহিনী নিয়ে।



[------ ধ্যাৎ, এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। শালার লোডশেডিং। বিদ্যুৎমন্ত্রির গোষ্টি গিলাই।

পুনশ্চ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রি, “ডিজিটাল বাংলাদেশ উইথ নো ইলেকট্রিসিটি” আমাদের দরকার নাই। প্লিজ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কিছু একটা ওয়ে বের করেন। আর কত! নাটক-ফাটক তো কিছুই দেখতে পারতেছি না। অন্তত ভালবাসায় লোডশেডিং কোনভাবেই মানা যায় না]
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ২০১০

কলেজ শেষের দিন (আজাইরা প্যাঁচাল)…….

আইজ আজাইরা প্যাঁচাল ছাড়া কিছু পাড়ুম না ঠিক কইচ্ছি। সো, গম্ভীর আর ভাববাদীরা এ পোস্ট মাড়াইয়েন না কইয়া দিলাম।

তখন ছিল কলেজ কাল। কলেজের নাম মুরারিচাদঁ কলেজ। কেমতে কেমতে কেটে গেল কলেজের দুই দুইটা বছর। টের পাইনি। সত্যই, মাঝি মাঝি ভাবি আর টাসকি খাই। আমার জীবনের সবচেয়ে মজাক সময় কেটেছে এই পাহাড় ঘেরা নয়নকাড়া কলেজটিতে। এই কলেজেরে চার বাইন্ডারির ভেতরেই আমার প্রখম নচিকেতা আর জেমসের ঝাকা-নাকা গানের সাথে মেশা। “লরেল জেল”এ মাখা চুল নিয়া আর ছয় প্যাকেট ওয়ালা জিন্সের ট্রাউজারে পাংকু কায়দায় পেছনের দুই প্যাকেটে হাত ঢুকিইয়া মাঞ্জা মেরে মেয়েদের সামনে দিয়া হেলেদুলে হাটাঁর ত তখন থেকেই শুরু। জীবনের প্রথম কোন রুপসী ললনার “এই উজবুক, রাস্তা মাপ” গালি শুনে টাসকি খাওয়া, প্রথম প্রেম, শেষ প্রেম, জেমস বন্ড সাবের মত সিগারেটে টান দিয়ে দিলদরিয়া হই যাওয়া, পাড়ার ভদ্র (!) পুলাপানগো লগে বইয়া নীল-লাল ছবি দেখা, এই রকম মেলা ঘটনার চাক্ষুস দাবীদার আমার এই কলেজ লাইফ।


মুই ছিলাম বেজায় ভালা (!) ছাত্র। দুই টার্ম ফাইনালের আগে নয়-নয় আঠার দিন আর দুই ইয়ার জেঞ্জের আগে চৌদ্দ-চৌদ্দ আঠাশ দিন, সর্বসাকুল্যে ছেছল্লিশ দিন ছাড়া বইয়ের ছায়ার ধার দিয়েও যেতাম না। কেউ এ নিয়ে টিটকারী মারলে সাথে সাথে রক্তিম চোখে রবীদা আর নিউটনের শিক্ষাজীবনীর দৃষ্টান্ত ঝাড়তাম। রবীদা আর নিউটন না, আমার চোখরাঙ্গানী দেইখা ওরা বলত, “ঠিকই তো, ছেছল্লিশ দিন তো মেলা দি, খাওয়া-দাওয়া কইরবেন নিয়মিত, স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাইখেন। পড়তে পড়তে তো কন্ঠনালী বের হয়ে পড়তাছে”।

সত্যই, ব্যাফক মজাকে মজাক দিন ছিল তখন। শুধু পরীক্ষা, থিসিস, প্রজেক্ট আর টার্ম ফাইনাল এইসব আজেবাজে, ফাউল জিনিসগুরো যদি না থাকত তাইলে লাইফটা আরো জোশ হইত। এইসব বিরক্তিকর জিনিসগুলো জ্বালাইয়া মারত সবসময়। এসবের জন্যি গন্ধরাজ নারিকেল তেল আর স্যান্ডেলিনা ডেইলি সোপের সৌজন্যে প্রচারিত “থ্রি স্ট্রুডিজ” টাও দেখতে পারতাম না নিয়মিত। আফসোস!

আমার কলেজ জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিল মাছুম স্যার। ভাল পড়ানোর জন্যি নয়, ক্লাসে অন্যদের থেকে আমাকে বেশি বেশি সমীহ করেন, সেটাও নয়, ক্লাসে এসে মজার মজার গল্প বলতেন, তাও নয়; উনি ক্লাসে পারসেন্টজ নেন না সেজন্য। আই লাভু স্যার, ইউ আর চো চুইট। অবশ্য পরীক্ষার দিন উনার বৈধ ছাত্র প্রমান দিতে শেষ পর্যন্ত আমাকে অবৈধ পথ নিতে হয়েছিল সেদিন। সে এক বিরাট ইতিহাস। আজ বলা যাবে না।

উড়া-ধোরা মতিলাল প্রফেসর। ডিজিটাল স্যার। ডিজিটাল ভাব (!) ছাড়া তো কথাই বলেন না। মেয়েদের যা বিশেষ পছন্দ ছিল। ক্লাসে পড়ানোর আগে মজার মজার গল্পও বলতেন, তাই ক্লাসে উপচে থাকত পড়া ভিড়। সামলানোই দায়। একদিন ভরা ক্লাসে স্যারের উড়া-ধোরা প্রশ্ন: “বলত, চন্দ্রশেখর জাহাজে বসে কিভাবে বিজ্ঞানী এডিংটনের সাথে যোগাযোগ রাখতেন?” সাথে সাথে ক্লাসের অন্যতম তুখোর ছাত্র তানভীরের ডিজিটাল উত্তর: “ইমেইলে স্যার”। পরে, স্যারের ডিজিটাল ঝাড়ি। “এত বেরেন লইয়া ঘুমাস কেমনে?”। মেয়েদের সামনে কঠিন ঝাড়ি খাইয়া তানভীর তো এক্কেবারে তব্দা। পরে এনালগি কায়দায় বেশি বেশি মার্ক দিয়া ডিজিটাল স্যার তার দিল-খুশ করাইছিলেন।

ফ্যাপড়া উত্তর দেয়া শুরু করেছিলাম সেকেন্ড ইয়ারের বায়োলজি প্র্যাকটিকেল ক্লাস থেকে। এক্সামিনার মাহবুব আখন্দ। প্রশ্ন দেইখা তো আমার মাথা ছানা-বাড়া। চোখে আন্ধার দেখতিয়াছি। কিছুই তো পারিনা। তাও নাছোড়বান্দা, উত্তর ছাড়া যাবে না। প্রশ্ন ছিল, উদ্ভিদের বিবর্তনবাদ ত্রিভুজাকার ছকের মাধ্যমে প্রদর্শন করে দেখাও। আর যাই কোথায়! সাথে সাথে কাঠপেন্সিল ভালভাবে সার্প করিয়া সুন্দর করে তিনটা ডান্ডি দিয়ে একটা ত্রিভুজ আকঁলাম আর মাঝখানে একটা হেইলা-দুইলা লতাগাছ একেঁ নিচে চিত্রের নাম দিলাম। “বিবর্তনবাদ: দুর্বাঘাস টু লাউগাছ”।

তখন চৈত্র মাস। কেমিস্ট্রি পরীক্ষার চারদিন আগের রাত। সবে নতুন বই খুললাম। ঘষামাজা নাই। চকচকে ঝকঝকে সব পাতা। পরীক্ষা আসলে আমার এমনিতেই অসুখ-বিসুখ শুরু হইয়া যায়। তারমধ্যে পুরা একদিন কেমিস্ট্রি নিয়ে ডুবে থাকা ওইদিন। বুঝেন অবস্থা। ফলাফল: প্রচন্ড মাথা-ধরা। ধরা মানে যেই-সেই না, যদু-মধু না, একেবারে রাম ধরা। অতিপঠনে শইল তো অভ্যস্ত না! মানবে কেমতে বলেন? মা মধুমাখা মুখে সাজেশান দিলেন, “যা বাইরে থেকে একটু হেটে আয়, ভাল লাগবে”। মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য। পালন করতেই হবে। হাটার আগে তুমুল পড়োয়া ছাত্রের মত দশটা রাসায়নিক যৌগের নাম একটি ছোট্ট কাগজে লিখে জপতে জপতে যাচ্ছিলাম। সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম নাইট্রেড, এইগুলান। বের হওয়ার আগে দাদু কয়েকটি বিদেশী সিনেমার লিস্টি দিয়েছিলেন। আসার সময় নিয়ে আসতে হবে, তিনি দেখবেন। ভিডিও মামাকে সিনেমার লিস্টি হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর বেটা কিছুক্ষন কঠিন মুখ করে তাকিয়ে এদিক-ওদিক দেখার পর বিরস মুখে বলল, “ভাই একটাও তো নাই, ছবিগুলা মনে হয় খুব লেটেস্ট”। দিলাম ঝাড়ি। “কি দোকান বসাইছেন মিয়া, এতগুলার মধ্যে একটাও থাকে না!” গৃহ প্রত্যাবর্তনের পর দাদুর টিটকারী, কিরে সিনেমার লিস্টিটা ফেলে গেলি যে? বুঝলাম, চৈত্রের গরম, বেরসের রসায়ন আর রসের মাথা-ধরা মিইল্লা আমার মাথা গেছে আউলাইয়া। আর আউলা মাথায় সিনেমার লিস্টি না দিয়ে দিলাম রাসায়নিক নামের লিস্টিটা। আর সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম নাইট্রেড এর লিস্টিটা দেইখাই ভিডিও মামা বিরস মুখে বলেছিল “ছবিগুলা নির্ঘাৎ লেটেস্ট, তাই একটাও তাদের কালেকশনে নাই”।

আমার আরেকজন টপ ফেবারিট স্যার ছিল, হৃষি কেশ স্যার। বিশাল গিয়ানি নুক। পাগলা কিসিমের, মাথা পুরাই আউলা। জটিল জটিল সূত্র পড়ান শুধূ। “হাইজেনবার্গ ল ইন মেট্রিক্স ফর্ম”- উনার প্রিয় সূত্র। ফেবারিট হওয়ার হেতু হল, উনি পরীক্ষার খাতায় চোখ বুলান না। খাতায় সব প্রশ্নের বিপরীতে কিছু লিখা আছে কিনা সেটাই উনার কাছে বিবেচ্য বিষয়। কি লিখা আছে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের সবার কাছে উনি তাই সিম্পলি জোশ স্যার। ফাইনাল পরীক্ষা। চারটি প্রশ্ন। তিনটি পারি, আরেকটা পারিনা। চিন্তা কি? তিন নম্বরটার উত্তরটাই চার নন্বরে আবার লিখলাম। রেজাল্ট? সেকেন্ড হাইঢেস্ট। মারহাবা।

এই ঘটনাটা আমাদের পপুলার পেসাব মকবুলকে (নিক নেম, ভয়ে আসল নাম মাড়াচ্ছি না) নিয়া (একবার এক স্যারের কঠিন ধমক খাওয়ার পর কে একজন তার প্যান্ট ভিজা দেখছিল, সেই থেকেই তার নাম পেসাব মকবুল)। প্রশ্নে বিশাল বড় একটা ঘটনার বিবরন দিয়ে শেষে ইংরাজিতে লিখা: “ড্র দি সিচুয়েশান হয়াট ইউ ওয়াচ..”। এই “ওয়াচ”-কে ঘড়ি আর “ড্র” মানে আঁকা ভেবে সে বড় করে একটা গোল্লা একেঁ চারদিক ঘুরিয়ে ১ থেকে ১২ পর্যন্ত লিখে তিনটা বড় বড় কাটাঁ আঁকল। নিচে ক্যাপশন দিল “দেয়াল ঘড়ি”, ইংরাজিতে "Wall Watch"। সেই ঘড়িতে সে বর্তমান সময়টাও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে একেঁ দিয়ে আসছিল। তারপরও সে কেন এখানে কোন মার্ক পেল না, এটা তার কাছে এখনও রহস্য। ----এরকমই বিচিত্র চরিত্রের Peculiar ঘটনার সমাবেশে বিচিত্রময় সমারোহে সমৃদ্ধ এই কলেজ জীবন। আর না। অনেক হইছে।

অনেক আউল-ফাউল কথা ঝাড়লমি। সময় খাকলে মন্তবাইন, আর পারলে দু'তিনটা কথা শুনিয়ে যাইয়েন। ভালু থাকইন। অনেক অনেক শুকরিয়া।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......