সোমবার, ১৭ মে, ২০১০

আমার দিনলিপি: "রুপসী ললনা" আর "বিজ্ঞান"

১৮ই মে, ২০১০: আজ একটা ওয়ার্কশপ ছিল। বিষয়: ন্যানোট্যাকনলজী ও তার এপ্লিকেশন। আয়োজনে ছিল কানাডার ওন্টারিও ন্যানোট্যাকনলজী রিচার্স ফোরাম। সেখানে আমার দায়িত্ব ছিল একটা পোস্টার প্রদর্শন করা। যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, পোস্টার প্রেজেন্টশনের মধ্যে আহামরি কিচ্ছু নাই। পোস্টার প্রেজেন্টশন হল শুধু যার যার পোস্টারের সামনে "ভ্যাবলার" মত দাড়িয়ে থাকা। আর কেউ এসে “দুনিযার সব জানে” এমন ভয়াবহ-জ্ঞানীর ভাব নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর তাদের মনে কোনো খটকা লাগলে তাদের খটকাগুলো দুর করা। তো, মুল ব্যাপার এটা না, মুল কথা হল, বরাবরের মতই আমার আনন্দ কখনই পোস্টার দেখানোতে থাকে না, আমার আনন্দ থাকে পোস্টার ছাপিয়ে রুপবতী ললনাদের সাথে কথা বলার সুবর্ন সুযোগ পাওয়ার মধ্যে। কিন্তু আজ পরিস্তিতি ভিন্ন। তিন ঘন্টার প্রেজেন্টশন এ দুই ঘন্টা চলে গেল, এখনও কোনো ললনা আমার পোস্টারের ধারে দিয়ে আসল না। ললনারা বামদিকের পোস্টারে আসে, ডানদিকে আসে। পেছনেরটাতে আসে, সামনের টাতেও আসে। আমারটাতে আসে না। বিরক্ত হয়ে আমার ঘনিষ্ট তুর্কি বন্ধু টমাসকে কিছু একটা করতে বললাম। সে বুদ্ধি দিল মেয়েরা আসতে দেখলে আশেপাশের বুড়া বুড়া প্রফেসরদের ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিবি, মেয়েরা বুড়া প্রফেসরদের পছন্দ করে না। তাদের ভয়ে হয়তো আসছে না। কথার সত্যতা পেলাম। আমার পোস্টারের সামনে বুড়াদের আনাগোনা। তার কথামত কাজ করতে লাগলাম। তাদেরকে ঠেলেঠুলে সরাতে লাগলাম। কিন্তু মামলা তা-ও তো খতরনাক।, পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই। আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলাম। হঠাৎ পরিস্থিতির আসন্ন উত্তরন দেখতে পেলাম। আমাদের প্রেজেন্টশেন শেষ হওয়ার মাত্র ৫ মিনিট আগে একজন চোখ-ঝলসানো সুন্দরী মেয়ে আমার পোস্টারের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে লাগল। মনে মনে বললাম এতক্ষনে বোধহয় উপরওয়ালা আমার পানে চোখ তুলে চেয়েছেন। যাক্, লাইফ মে কোচ্ সাদা হে। আমি তখন পোস্টারে প্রদর্শিত রিসার্চের সকল সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর মনে মনে সাজিয়ে নিতে লাগলাম। মেয়েটির প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খুব ভালভাবে সাজিয়ে সুন্দর করে বলতে হবে। কোনো উত্তরই ল্যাজে-গোবরে করা যাবে না। কবি বলেছেন, “যদিবা অর্জিত করিতে হয় নারীমন, কথামালা সাজানো চাই অনন্য মধুক্ষন”। মেয়েটি যতই আমার কাছাকাছি আসতে লাগল আমার বুক ধড়ফড়ানি ততই বাড়তে লাগল। না জানি কি প্রশ্ন করে বসে! সাধারন গাধাটাইপ মানুষদের প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেখানে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর আসে, আর এ তো মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী ললনা। তো মেয়েটি একসময় আমার সান্নিধ্যে আসল, কাছে আসার পর ক্ষনিকের জন্য আমার পোস্টারের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম আমার সাজানো কথামালাগুলো উদ্গরনের জন্য। এমন সময় মেয়েটি তার সুচিন্তিত প্রশ্নবাক্যটি ঝড়ো বেগে প্রকাশ করল। যা শুনে আমার ভ্রম্মতালু ছুয়ে বুঝতে পারলাম, চান্তি কিছুটা হলেও পুড়ে গেছে। মেয়েটি অসহায়ত্বের মত ভঙ্গি করে আমাকে যে প্রশ্নটি করেছেল সেটা হল: “Excuse me, could u tell me please where can I find the toilet?????, its emergency.”

পরিশিষ্ট: "কোথায় জানি পড়েছিলাম, সুন্দরী আর বিজ্ঞান সাথ সাথ যায় না।"
কথাটা মনে হয় একেবারে মিছা না! আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

শনিবার, ৮ মে, ২০১০

মা

[আজ মায়ের সাথে অকারনে রাগ করলাম। অনেকটা ইচ্ছে করেই। আমার মা আমার থেকে হাজার মাইল দুরে। প্রতিদিন আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকেন মা। না দিলে ধৈর্য্যহারা হয়ে নিজেই করে বসেন। মা, এত ভালবাসা কেন তোমার? এত কষ্ট দেই, তারপরও ভালবাসা ফুরায় না কেন তোমার? রাগারাগির পর খুব খারাপ লাগছিল আমার। সেটা কমাতেই এই আবেগী কবিতা। কবিতা হয়তো হয়নি, কিন্তু মায়েদের ভালবাসা এমন যে, তাদেরকে উপজিব্য করা কোন আবেগের বহিপ্রকাশ কোন ব্যর্থতাকে স্পর্শ করতে পারে না। সকল অপরিপক্কতা ছাপিয়ে ঠিকই উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় হয়ে উঠে সেই সত্তা তার নিজস্ব ভঙ্গিমায়। এটা লিখার সময় মাকে খুব অনুভব করেছিলাম, সেই ভাল লাগার অনুভুতিই প্রকাশ করলাম। প্লিজ খারাপ লাগলে গালি দিয়েন না, অন্তত]


মা,
সেই ছোট্টবেলায় প্রথম যেদিন
মিতালীপাড়ার স্কুলের আঙ্গিনার
পদধুলি দেবার কথা আমার,
তুমি মাথায় সিঁথি তুলে আশীষ দিয়েছিলে,
“বড় হও, বাবা, অনেক বড়,
মানুষ হিসেবে পূর্ন হয়”।
তোমার চোখে ছিল আমার জন্য আকাশছোঁয়া স্বপ্ন, মা।
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম
তোমার দিকে নিরিবিলি,
আমার দেখা সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানুষটির দিকে।

মা,
মেঘেদের যুদ্ধে ছিল বৃষ্টিদের বিজয়ের দিন সেদিন।
তুমি ছাতা দিয়ে বলেছিলে, “সাথে রাখিস বাবা”
আমি নেইনি সেদিন, তোমার দেয়া।
হয়তো ভেবেছিলাম, তোমার মত এত বড়
ছাতা থাকতে কোন ঝড়ের ভয় মা?
কোন ঝড়ের ভয়?

ঠিকই অঝোড় ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন
নুড়িপাড়ার সাধনবাবুর দোকানে আটকা পড়েছিলাম,
অনেকক্ষন।
তুমি নিজে ভিজে চলে এসেছিলে আমাকে
অভেজা নিয়ে যেতে, মেঘেদের আড়াল করে।
খালি পায়ে।
আমার কয়েক ভেজা চুল তোমার আঁচল দিয়ে
মুছে দিতে দিতে মায়াভরা গলায় শাসন করেছিলে,
“আর কোনদিন ভিজবি না বৃষ্টিতে, ঠিক আছে?”
তোমার উষ্ঞ আচঁল দিয়ে আগলে ধরে রাখছিলে তুমি
আমায় কিছুক্ষন, গভীর মমতায়,
তোমার সিক্ত আশ্রয়ে।

মা,
পৌষের সংক্রান্তি ছিল ওইদিন।
ভোরের স্নান সেরে সোজা চুলার পাশে আমি।
তুমি পিঠা বানাচ্ছিলে,
কপালে তোমার বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বসে রইলাম তোমার দিকে চেয়ে মুগ্ধ নয়নে।
তুমি পাঠিসাপটা বানিয়ে দিতে লাগলে, অনবরত।
খাওয়া শেষে কম পড়েছিল বলে, তুমি
নিজে খাওনি সেদিন, বলেছিলে,
“তোরা খা, এতেই আমার তৃপ্তি”

মা,
জৌষ্ঠের নবান্নৎসবের ছুটি তখন,
দক্ষিনপাড়ার নবনীবাবুর কুয়োর ধার দিয়ে,
আসার সময়,
পড়ে জখম হয়েছিল খুব।
নিমপাতার রস লাগিয়ে দিয়েছিলে সেদিন,
উপরে কলাপাতার পট্টি, পরম যতনে।
তবু ক্ষতের নিস্তার নেই,
পায়ের জখম বিদ্রোহ করেছিল সেদিন রাত।
প্রবল জ্বরে কেঁপে কেঁপে উঠেছিলাম,
নকশীকাঁথায় ঢেকেও স্বস্তি নেই তোমার,
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঢেলে দিতে লাগলে
তোমার শরীরের ওম।
সারা রাত জেগে নির্ঘুম তুমি
মাখতে লাগলে জ্বল পট্টি, আমার তপ্ত কপালে,
পরম আদরে।
টলমল করছিল সেদিন
তোমার স্নেহঝড়ানো উদ্বিগ্নতার জ্বল।

মা,
আমার টিউশনির টাকা
একটু একটু করে জমিয়ে,
তোমাকে একটি নীল শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম,
তোমার সেই শাড়ি গায়ে দিতে না তুমি
আলমারিতে যত্নে রাখ, সবসময়।
নষ্ট হয়ে যাবে বলে।

দেশের পড়া শেষে,
স্কলারশীপ নিয়ে হাজার মাইল দুরে আসার সময়,
আবেগি তুমি, কান্না থামিয়ে রাখতে পারছিলে না।
আচঁল দিয়ে চোখ লুকিয়ে রাখলে।
আসার বেলায়,
কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলে,
“ভাল থাকিস, বাবা”।
ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম আমি।

সেই তুমি আজ অনেকটাই জীর্ন।
রান্নাঘর থেকে সিংহদার,
এটুকুনই তোমার সকল ভাবনায়।
খুঁজে বেড়াও আমাদের, প্রতিটি মুহুর্ত।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার একটি ফোনের জন্য
অপেক্ষা করে বসে থাকো রিক্ত তুমি,
চাতকপাকির মত।
একদিন কথা না বললে
অস্থির হয়ে রাগ করে বসে থাকো,
অবোধ শিশুটির মত।

মা,
আচ্ছা আমি কি পারব, তোমার স্বপ্নটি পুরন করতে?
অনেক বড় হতে কথনও?
অথবা,
মানুষের পুর্নতা নিতে?
ভয় হয়, মা।
আমার।
একটু মাথায় তোমার আশীষের হাতটি বুলিয়ে দিবে, মা, ঠিক আগেটির মত।

আঁকা: নিজ, সাল: ২০০৩, পেন্সিল স্কেচ।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......