শনিবার, ৮ মে, ২০১০

মা

[আজ মায়ের সাথে অকারনে রাগ করলাম। অনেকটা ইচ্ছে করেই। আমার মা আমার থেকে হাজার মাইল দুরে। প্রতিদিন আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকেন মা। না দিলে ধৈর্য্যহারা হয়ে নিজেই করে বসেন। মা, এত ভালবাসা কেন তোমার? এত কষ্ট দেই, তারপরও ভালবাসা ফুরায় না কেন তোমার? রাগারাগির পর খুব খারাপ লাগছিল আমার। সেটা কমাতেই এই আবেগী কবিতা। কবিতা হয়তো হয়নি, কিন্তু মায়েদের ভালবাসা এমন যে, তাদেরকে উপজিব্য করা কোন আবেগের বহিপ্রকাশ কোন ব্যর্থতাকে স্পর্শ করতে পারে না। সকল অপরিপক্কতা ছাপিয়ে ঠিকই উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় হয়ে উঠে সেই সত্তা তার নিজস্ব ভঙ্গিমায়। এটা লিখার সময় মাকে খুব অনুভব করেছিলাম, সেই ভাল লাগার অনুভুতিই প্রকাশ করলাম। প্লিজ খারাপ লাগলে গালি দিয়েন না, অন্তত]


মা,
সেই ছোট্টবেলায় প্রথম যেদিন
মিতালীপাড়ার স্কুলের আঙ্গিনার
পদধুলি দেবার কথা আমার,
তুমি মাথায় সিঁথি তুলে আশীষ দিয়েছিলে,
“বড় হও, বাবা, অনেক বড়,
মানুষ হিসেবে পূর্ন হয়”।
তোমার চোখে ছিল আমার জন্য আকাশছোঁয়া স্বপ্ন, মা।
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম
তোমার দিকে নিরিবিলি,
আমার দেখা সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানুষটির দিকে।

মা,
মেঘেদের যুদ্ধে ছিল বৃষ্টিদের বিজয়ের দিন সেদিন।
তুমি ছাতা দিয়ে বলেছিলে, “সাথে রাখিস বাবা”
আমি নেইনি সেদিন, তোমার দেয়া।
হয়তো ভেবেছিলাম, তোমার মত এত বড়
ছাতা থাকতে কোন ঝড়ের ভয় মা?
কোন ঝড়ের ভয়?

ঠিকই অঝোড় ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন
নুড়িপাড়ার সাধনবাবুর দোকানে আটকা পড়েছিলাম,
অনেকক্ষন।
তুমি নিজে ভিজে চলে এসেছিলে আমাকে
অভেজা নিয়ে যেতে, মেঘেদের আড়াল করে।
খালি পায়ে।
আমার কয়েক ভেজা চুল তোমার আঁচল দিয়ে
মুছে দিতে দিতে মায়াভরা গলায় শাসন করেছিলে,
“আর কোনদিন ভিজবি না বৃষ্টিতে, ঠিক আছে?”
তোমার উষ্ঞ আচঁল দিয়ে আগলে ধরে রাখছিলে তুমি
আমায় কিছুক্ষন, গভীর মমতায়,
তোমার সিক্ত আশ্রয়ে।

মা,
পৌষের সংক্রান্তি ছিল ওইদিন।
ভোরের স্নান সেরে সোজা চুলার পাশে আমি।
তুমি পিঠা বানাচ্ছিলে,
কপালে তোমার বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বসে রইলাম তোমার দিকে চেয়ে মুগ্ধ নয়নে।
তুমি পাঠিসাপটা বানিয়ে দিতে লাগলে, অনবরত।
খাওয়া শেষে কম পড়েছিল বলে, তুমি
নিজে খাওনি সেদিন, বলেছিলে,
“তোরা খা, এতেই আমার তৃপ্তি”

মা,
জৌষ্ঠের নবান্নৎসবের ছুটি তখন,
দক্ষিনপাড়ার নবনীবাবুর কুয়োর ধার দিয়ে,
আসার সময়,
পড়ে জখম হয়েছিল খুব।
নিমপাতার রস লাগিয়ে দিয়েছিলে সেদিন,
উপরে কলাপাতার পট্টি, পরম যতনে।
তবু ক্ষতের নিস্তার নেই,
পায়ের জখম বিদ্রোহ করেছিল সেদিন রাত।
প্রবল জ্বরে কেঁপে কেঁপে উঠেছিলাম,
নকশীকাঁথায় ঢেকেও স্বস্তি নেই তোমার,
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঢেলে দিতে লাগলে
তোমার শরীরের ওম।
সারা রাত জেগে নির্ঘুম তুমি
মাখতে লাগলে জ্বল পট্টি, আমার তপ্ত কপালে,
পরম আদরে।
টলমল করছিল সেদিন
তোমার স্নেহঝড়ানো উদ্বিগ্নতার জ্বল।

মা,
আমার টিউশনির টাকা
একটু একটু করে জমিয়ে,
তোমাকে একটি নীল শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম,
তোমার সেই শাড়ি গায়ে দিতে না তুমি
আলমারিতে যত্নে রাখ, সবসময়।
নষ্ট হয়ে যাবে বলে।

দেশের পড়া শেষে,
স্কলারশীপ নিয়ে হাজার মাইল দুরে আসার সময়,
আবেগি তুমি, কান্না থামিয়ে রাখতে পারছিলে না।
আচঁল দিয়ে চোখ লুকিয়ে রাখলে।
আসার বেলায়,
কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলে,
“ভাল থাকিস, বাবা”।
ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম আমি।

সেই তুমি আজ অনেকটাই জীর্ন।
রান্নাঘর থেকে সিংহদার,
এটুকুনই তোমার সকল ভাবনায়।
খুঁজে বেড়াও আমাদের, প্রতিটি মুহুর্ত।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার একটি ফোনের জন্য
অপেক্ষা করে বসে থাকো রিক্ত তুমি,
চাতকপাকির মত।
একদিন কথা না বললে
অস্থির হয়ে রাগ করে বসে থাকো,
অবোধ শিশুটির মত।

মা,
আচ্ছা আমি কি পারব, তোমার স্বপ্নটি পুরন করতে?
অনেক বড় হতে কথনও?
অথবা,
মানুষের পুর্নতা নিতে?
ভয় হয়, মা।
আমার।
একটু মাথায় তোমার আশীষের হাতটি বুলিয়ে দিবে, মা, ঠিক আগেটির মত।

আঁকা: নিজ, সাল: ২০০৩, পেন্সিল স্কেচ।

২টি মন্তব্য:

  1. গন্তব্যহীন৯ মে, ২০১০ এ ২:০৭ AM

    আমি জানিনা একে কি বলে......এ রকম আবেগি লেখা অনেকদিন পরিনি...... সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখ ভিজে গেল......আরো অনেক দিন তোমার মা বেচে থাকুক.....আরও বেশি মায়ের ভালবাসায় সিক্ত হও তুমি .....

    উত্তরমুছুন
  2. রাসেল, তুমি কি বলে ধন্যবাদ দিব বুঝতেছি না, মনে হচ্ছে তোমার মন্তব্যগুলো আমার অপরিপক্কতার বিপরীতে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। তোমার কথাগুলো খুব টাচ করল। অনেক ধন্যবাদ, মায়ের জন্য আশীর্বাদ করার জন্য। তুমি তোমার সফল গন্তব্যের দিকে চলে যাও এই কামনা করি সমসময়। নিযুত শুভাশিষ।

    উত্তরমুছুন