সকাল থেকেই অঝোরধারায় বৃষ্টি ঝরছে। কানাডাতে শীতকালেই বৃষ্টি হয় বেশী। আমাদের দেশের অনেকটাই বিপরীত। ইউনিভাসির্টি যাব, কিন্তু প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি দেখে সিদ্ধান্ত বাদ দিলাম। থাক আজ না গেলে এমন কোন ক্ষতি হবে না। ফ্রেশ হয়ে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে জানালার সামনে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবলাম আজ একটু বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করলে কি হয়। তাছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বিজ্ঞানবিষয়ক একটা কিছু তো লিখাই যায়। তাহলে চলুন আর কথা না বাড়িয়ে বিজ্ঞানের অন্যতম বড় প্রজেক্ট এলএইচসি হয়ে ঘুরে আসি।
বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থ ও জ্যোতির্বিদ্যা এমন এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নতুন জ্ঞান আহরণ, নতুন কণা আবিষ্ককার বা মহাশুন্যের সুদুরতম প্রান্তের গ্যালাক্সি দেখার জন্য বিশেষ যন্ত্রের দরকার, আর যা তৈরি করতে অনেক দেশের শত শত বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বহুদিনের শ্রম প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, এ ধরনের কাজে শুধু যোগ্য ব্যক্তিদের মেধা ও দক্ষতাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য দরকার প্রচুর অর্থেরও। সেই অর্থ নিশ্চিত করতে বিজ্ঞানীদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিস্তারিত প্রস্তাব দিতে হয়, কোনো নির্দিষ্ট অর্থ-পরিমাণের জন্য অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। পরিকল্পনা, অর্থ সংগ্রহ ও নির্মাণের সময় যোগ করলে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় দুই দশক পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
বড় বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় নির্মিত লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি)। বলা হয়ে থাকে, এলএইচসি মানুষের তৈরি সবচেয়ে জটিল যন্ত্র। কাজেই এটা বড় প্রযুক্তির অন্যতম উদাহরণ। মাটির ৫০ থেকে ১৭৫ মিটার নিচে ২৭ কিলোমিটার পরিধির এই চক্রাকার যন্ত্রটি প্রোটন কণাকে আলোর গতির খুব কাছাকাছি নিয়ে যায় এবং এরপর সেই উচ্চ গতিশীল কণাগুলোকে একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। সেই সংঘর্ষে অজানা সব নতুন কণার জন্ন নেওয়ার কথা, যার মধ্যে বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন হিগস নামের একটি কণা। হিগস কণা বা হিগস বোসন বস্তুর কেন ভর (বা ওজন) আছে, তার উত্তর দেবে।

লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এর এরিয়া
ষাটের দশকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী (পিটার হিগস তাঁদের অন্যতম) এমন একটি ক্ষেত্রের কথা ভাবেন, যা বিভিন্ন কণার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে সেই কণাগুলোর ভর দেয়, অর্থাৎ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে তাদের ওজন থাকবে। ইলেকট্রন যদি দ্রুত ভ্রমণ করতে চায়, তাহলে হিগস ক্ষেত্র তাকে শ্লথ করে দেবে, কিন্তু আমাদের মনে হবে ইলেকট্রনের ভর (বা ওজন) আছে বলে সে দ্রুত যেতে পারছে না। আসলে সেই ভরটা আসছে হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে ইলেকট্রনের বিক্রিয়ার ফলে। হিগস ক্ষেত্র না থাকলে কোনো কণা তথা বস্তুরই ভর (বা ওজন) থাকত না।

লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এর ভেতর
হিগস ক্ষেত্র যে আছে, সেটা কী করে প্রমাণ করা সম্ভব? একটি গতিশীল ইলেকট্রন কণার সঙ্গে যেমন একটি তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র থাকবে, তেমনি এটা অনুমান করা যায় যে হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে থাকতে হবে একটি হিগস কণা (বা হিগস বোসন)। সেই হিগস কণা আবিষ্ককারের জন্য এলএইচসির সৃষ্টি, যদিও এলএইচসির অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে আছে সুপার-সিমেট্রিক কণাসমূহ বলে একদল ভাবীকথিত কণার সন্ধান এবং আমাদের পরিচিত তিনটি স্থান-মাত্রার বাইরে অন্য কোনো মাত্রা আছে কি না, তার অনুসন্ধান। নিঃসন্দেহে এসব গবেষণা আমাদের এই মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত গঠন চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।

লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এর ভেতর
এলএইচসি যন্ত্রের মূলে আছে প্রায় এক হাজার ৬০০টি উচ্চ ক্ষমতাশালী তড়িৎ-চুম্বক, যা প্রোটনসহ বিভিন্ন আধানযুক্ত কণাগুলোকে একটি চক্রাকার পথের সুড়ঙ্গে পরিচালিত করে। ২৭ টন ওজনের একেকটি চুম্বককে সব সময় পরম শুন্য তাপমাত্রার (মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) কাছাকাছি রাখতে হয়। এই হিমায়নপ্রক্রিয়ার জন্য প্রায় ১০ হাজার টন তরল নাইট্রোজেন ও ১২০ টন তরল হিলিয়ামের প্রয়োজন হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে উৎপাদিত সমগ্র হিলিয়ামের একটি বিশাল অংশ এলএইচসির কাজে ব্যবহূত হয়েছে। এলএইচসির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত আছেন ১০০টি দেশের প্রায় ১০ হাজার বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী। এতে আপাতত খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ শ কোটি ডলার। ৩৩টি দেশের ১৫২টি কম্পিউটার কেন্দ্রের সমন্বয়ে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার একক প্রসেসর দিয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কম্পিউটার, যা এলএইচসির উপাত্ত বিশ্লেষণ করবে।

লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এর ভেতর
বড় বিজ্ঞান এবং এর সঙ্গে যুক্ত জটিল যন্ত্রের সঙ্গে আসে বিপজ্জনক সমস্যা। স্বাভাবিকভাবেই এলএইচসির মতো বিশাল যন্ত্রের প্রতিটি খুঁটিনাটি সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।
২.
পর্ব-১
এলএইচসি চালু হওয়ার মাত্র নয় দিনের মাথায় একটি বৈদ্যুতিক বিভ্রাটের ফলে প্রায় ছয় টন হিলিয়াম তার আবেষ্টনের বাইরে বেরিয়ে যায়। এতে হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের দ্রুত পতনের ফলে এক বিশাল পরিমাণ শক্তি বিমুক্ত হয়। সেই বিস্কোরণ বেশ কয়েকটি ভারী চুম্বককে মেঝে থেকে উপড়ে ফেলে। মাটিতে পড়া হিলিয়াম এলএইচসির টানেলকে এত শীতল করে দেয় যে কর্মীরা প্রায় কয়েক সপ্তাহ সেখানে ঢুকতে পারেননি। টানেলের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ঠিক করতে এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে অনেক সময় লাগবে। অর্থাৎ ২০১০ সালের আগে এলএইচসি চালু করা যাবে না।

লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এর ভেতর
বহু বছর আগে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলতে আমাদের কাছে যে চিত্রটি ফুটে উঠত, তা হলো আইস্টাইন একা তাঁর ডেস্কে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন বা সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অফিসে বসে নিভৃতে আইনস্টাইনকে তাঁর কাজ সম্পর্কে চিঠি লিখছেন। তাত্ত্বিক বিজ্ঞান এখনো কিছুটা এভাবে কাজ করলেও সারা বিশ্বের যোগাযোগব্যবস্থা (বিশেষত ইন্টারনেট) উন্নত হওয়ার ফলে কাগজ-কলম নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সতীর্থদের সঙ্গে খুব সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন।

লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এর ভেতর
অন্যদিকে রসায়ন ও জীববিজ্ঞান অতি দ্রুত আন্তবিষয়ক হয়ে উঠছে; যার মানে, তাঁদের গবেষণার বিষয় ও পদ্ধতি বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, জীববিদ ও কম্পিউটার-প্রকৌশলীরা একসঙ্গে গবেষণা করছেন মস্তিষ্কেকর নিউরন কোষের ওপর। তাঁরা বুঝতে চাইছেন, কেমন করে নিউরনরা একে অন্যের সঙ্গে নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে যোগাযোগ করে স্নৃতি ও স্বজ্ঞার সৃষ্টি করে। অথবা উপরিউক্ত সবাই এবং ভুবিদ ও পরিবেশ-প্রকৌশলীরা কাজ করছেন কেমন করে বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমাণ কমানো যায় বা কেমন করে সুর্য, বায়ু বা জোয়ার-ভাটা থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করা যায়, তা নিয়ে। পাশ্চাত্যের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্তবিষয়ক বিষয়ে পিএইচডি দিচ্ছে, যেমন−যুক্তভাবে জীব-রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বা কম্পিউটার ও জীববিদ্যায়। স্মাতক পর্যায়ে অনেক অভিসন্দর্ভর বিষয়ই এখন আন্তবিষয়ক।

স্টিফেন হকিং লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) ঘুরে গেছিলেন
তার মানে এই নয় যে পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের মূল সব বিষয়ের সমাধান হয়ে গেছে। এর মানে হচ্ছে, আমরা আবার বিজ্ঞানের একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছি। মূল তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের পরের পদক্ষেপটি নেওয়ার জন্য পর্যবেক্ষণ লাগবে। কারণ, পর্যবেক্ষণ ছাড়া বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে যে মডেল প্রণয়ন করছেন, তার সত্যতা যাচাই করা যাবে না। আর পর্যবেক্ষণের জন্য লাগবে বড় বিজ্ঞান ও বড় ধরনের প্রযুক্তি−হাবল টেলিস্কোপ বা এলএইচসি-জাতীয় যন্ত্র, যে দুটি প্রকল্পের প্রতিটির জন্যই পাঁচ শ কোটি ডলারের বেশি খরচ হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, আপাত দৃষ্টিতে প্রায়োগিক মূল্যহীন বিজ্ঞানের পেছনে এত সম্পদ বিনিয়োগের অর্থ কি? প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক নয়, তবে কোন বিজ্ঞান প্রয়োজনীয়, কোন বিজ্ঞান অপ্রয়োজনীয় এবং সামগ্রিকভাবে সভ্যতার বিকাশে জ্ঞানের গঠনের স্বরূপ কী হওয়া উচিত, এ ধরনের বিতর্কে না গিয়ে আমি অন্য কিছু প্রকল্পের পেছনে কত খরচ হয়েছে, তার একটি তালিকা দেব। মানবজাতির অন্যতম সফল প্রকল্প অ্যাপোলো কর্মসুচি চাঁদের বুকে ১২ জন মানুষকে হাঁটাতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত এ কর্মসুচির জন্য খরচ হয়েছে ২০০৫ সালের ডলার হিসাবে প্রায় ১৩ হাজার পাঁচ শ কোটি। সবচেয়ে ব্যস্ত বছরে প্রায় চার লাখ লোক বিভিন্নভাবে এ কর্মসুচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে নাসার বাজেট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে এটা এসে দাঁড়িয়েছে শুন্য দশমিক ৫২ শতাংশ, যদিও আসল ডলার হিসাবে এটা কমেছে মাত্র অর্ধেক। অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের জন্য খরচ হয়েছে ৬৮৬ বিলিয়ন ডলার (২০০৮ সালের ডলার হিসাবে), সর্বোচ্চ খরচের বছরে এই যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উৎপাদনের ২ দশমিক ৩ শতাংশ দাবি করেছে (জীবনের ক্ষয়ক্ষতি নাহয় বাদই দিলাম)। অন্যদিকে ৯/১১-এর পর গত বছর পর্যন্ত ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধসহ যুক্তরাষ্ট্রের ৮৫ হাজার নয় শ কোটি ডলার খরচ হয়েছে, যা সর্বোচ্চ খরচের বছরে জাতীয় উৎপাদনের ১ দশমিক ২ শতাংশ। নিঃসন্দেহে এসব সংখ্যার পাশে এলএইচসির পাঁচ শ কোটি ডলার খুবই নগণ্য। তদুপরি বড় বিজ্ঞান থেকে আমরা যে জ্ঞান আহরণ করব, তা সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি স্থায়ী সম্পদ বলে বিবেচিত হবে।

লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এর ভেতর
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পেছনে কোন দেশ কতখানি বাজেট বরাদ্দ করবে, সেটা সেই দেশের সংগতির ওপর নির্ভর করবে। তবে যেকোনো দেশের বাজেটে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের পেছনে কতখানি বরাদ্দ আছে, তা দিয়ে সেই দেশের ভবিষ্যৎমুখিতা নির্ণয় করা যায়। ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ তার জাতীয় উৎপাদনের ২ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ করেছিল (স্থান ১১৯), যেখানে ভারতের শিক্ষা বরাদ্দ ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ (স্থান ৮১), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ (স্থান ৩৭), নরওয়ের ৭ দশমিক ৬ শতাংশ (স্থান ১৪) ও কিউবার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ (স্থান ১)। শিক্ষাক্ষেত্র কোনো সময়ই বাংলাদেশের বাজেটে অগ্রাধিকার পায়নি। বাজেট প্রকাশের পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বরাদ্দ নিয়ে সংবাদমাধ্যমেও তেমন আলোচনা হয়নি।
Courtesy: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে জ্যোতির্বিদ্যার গবেষক দীপেন ভট্টাচার্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন