বঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল (অব.) শরীফুল হক ডালিম দু’সপ্তাহ কানাডায় অবস্থান করেছেন। আর বহন করছেন অন্য একটি দেশের পাসপোর্ট । এই পাসপোর্টের কারণেই ডালিম ঘুরে বেড়াচ্ছেন নানা দেশ। একাধিক নির্ভরযোগ্য সুত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ২ নভেম্বর কানাডার রাজধানী অটোয়াতে এসেছিলেন ডালিম। অটোয়ার ৩৩ নিকোলাস স্ট্রিটের নভোটেল হোটেলের ৩৩৪ নম্বর রুমে ছিলেন একটানা ৮ দিন। সেখানে বসেই একজন বাঙালি ইমিগ্রেশন কনসালটেন্টের সাথে দু’দফা বৈঠক করেন। ধারণা করা হচ্ছে, ইমিগ্রেশন বিষয়ক আলোচনা হয় তাদের মধ্যে। হোটেল রুমে বসেই প্রচুর ফোন কল করেছেন ডালিম, যার বেশিরভাগই পাকিস্তান, হংকং এবং লিবিয়ায়।এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে নভোটেল হোটেলের রুম ডিভিসন ম্যানেজার এলেক্স গ্রিকোরেস্কু বলেন, কাস্টমারের কোনো তথ্য আমরা থার্ড পার্টির কাছে সরবরাহ করতে পারিনা। তাই বিস্তারিত কিছু জানাতে পারছি না। সূত্র মতে, ১৩ নভেম্বর সকাল ১০টায় নভোটেল থেকে চেক আউট হন ডালিম। একইদিন রাতে আসেন টরন্টো । সেই রাতে মার্খামের এক আত্নীয়ের বাসায় রাত কাটান । পরের দিন ১৪ নভেম্বর রাত ১২ টা ১০ মিনিটে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের সিএএক্স-২৭ নম্বর ফ্লাইটে হংকং এর উদ্দেশ্যে টরন্টো ত্যাগ করেন। বর্তমানে ডালিমের অবস্থান নিয়ে দু’ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। একটি সূত্র বলেছে, ডালিম এখন হংকং অবস্থান করছেন। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানে অবস্থানের কথা। আরো জানা গেছে, সে এখন বৃটিশ পাসপোর্ট বহন করছেন। এ কারণেই যে কোনও সময় যে কোনও দেশ ভ্রমণ করতে পারছেন। তবে ডালিমের একজন ঘনিষ্ঠভাজন এই তথ্যটি সঠিক নয় বলে জানান।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পর ৪ নভেম্বর ডালিমসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একটি বিশেষ বিমানে রেঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাকিস্তান সরকারের দেয়া একটি বিমানে তাদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন এই ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানকারী লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ চাকরিতে যোগ দিতে রাজি হননি। তারা সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। এদের মধ্যে লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমকে চীন দূতাবাসে প্রথম সচিব, লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব ও ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।
পরে একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে লিবিয়ায় বদলি করা হয় সচিব পদে এবং লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদকে আলজেরিয়ার দ্বিতীয় সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। মেজর রাশেদ চৌধুরীকে আবার পরে চীন দূতাবাসে স্থায়ী পদে যুক্ত করা হয়। কর্নেল কিসমত হাশেমকে পরে আবার দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
পরবর্তীতে এরশাদ সরকার ডালিমকে বেইজিংয়ে নিয়োগ দিতে গিয়ে না পেরে পরে হংকংয়ে ভারপ্রাপ্ত মিশন প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেন। পোল্যান্ডে ডালিমকে একই পদে নিয়োগ দিলেও সেদেশের সরকার তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর লন্ডনে এরশাদ ও ডালিমের মধ্যে এক বৈঠকের ভিত্তিতে তাকে কেনিয়াতে হাইকমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়। ডালিম নানা জায়গায় অনেক অঘটনের জন্ম দেন। তাকে পোল্যান্ড সরকার গ্রহণ না করায় সে নিয়োগের আদেশ না থাকা সত্ত্বেও লন্ডন চলে আসে। এরশাদ লন্ডন সফরের সময় হিথ্রো বিমান বন্দরের এলকক এন্ড ব্রাউন স্যুটে এবং পরবর্তীতে হোটেলে তার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। অথচ সে সময় তার কোন নিয়োগপত্র ছিল না। কেনিয়া সরকার ডালিমের অকূটনীতিসুলভ আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সরকারের কাছে অভিযোগ করে। ডালিম চীনে কর্মরত অবস্থায় সেখানকার রাষ্ট্রদূত আব্দুল মমিনকেও নানাভাবে হেনস্তা করেন। কেনিয়া এবং লিবিয়াতে ডালিমের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিমের কানাডা সফরের খবরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।
শান্তিপ্রিয় কানাডা কী খুনীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারি লে. কর্নেল (অব.) শরীফুল হক ডালিম ও লে. কর্নেল (অব.) এসএইচ এমবি নূর চৌধুরী এখন কানাডায় অবস্থান করছেন। এমন খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় এই নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের আইনমন্ত্রীও এসেছিলেন কানাডায়। কানাডা সরকারের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথেও বৈঠক করেছেন। কথা বলেছেন কানাডিয়ান আইনজীবিদের সাথে।এ্যাটর্নি জেনারেলের সাথে বৈঠকের খবরও জেনেছি আমরা। ফলাফল কী হবে সেটা আমরা জানিনা। তবে একজন বাংলাদেশি কানাডিয়ান হিসাবে বলতে দ্বিধা নেই, কানাডা খুনীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে না। খুনীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে বেশ কিছু আইনগত জটিলতা আছে। কিন্তু এই জটিলতা কাটিয়ে ওঠা অসাধ্য কিছু নয়। কানাডা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ অবশ্য বলেছেন, তারা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু খুনীদের বহিস্কারের দাবিতো সবার দাবি হওয়া উচিত। আপনি কেনো নিরব? আওয়াজ তুলুন এখনই। কলংকমোচনের এই যাত্রায় আপনিও শরিক হোন।
তথ্যসূত্র: টরোন্ট কেন্দ্রিক বাংলা সাপ্তাহিক "বেঙ্গলি টাইমস", বিডি কানাডা ডেইলি এবং অন্যান্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন