অনেকক্ষন ধরেই একটি ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ধ্বংসাবশেষের ছবি, চারিদিকে পোড়া ভিটেমাটির চালা, খড়-মাটি, শস্যপোড়া ছাইয়ের প্রলেপ, তছনছ করা আসবাব-পত্র, পোড়া স্যান্ডেল, জ্বলা গাছের বৃদ্ধ-গুঁড়ি, আরও অনেক টুকিটাকি। এর মধ্যে ঠাঁয় দাড়িয়ে আছে একটি সুন্দর বৌদ্ধমূতিঁ। ছবিটি পাহাড়িদের উপর হামলা সম্পর্কিত প্রায় সকল পত্রিকার ফিচার নিউজগুলোতে এসেছিল। এই সপ্রতিভ বৌদ্ধমূতিঁটি যেন আগ্রাসি বাঙ্গালীদের দিকে তাকিয়ে হাসছে অবজ্ঞাভরে। তার উজ্জ্বল চোখগুলো যেন লাগামহীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁনোর প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পাহাড়ীদের দুর্নিবার আহবান জানাচ্ছে। মূর্তিগুলোর খোলা চোখ এই ধ্বংসাবশেষের মাঝেও তাদের প্রানবন্ত উপস্থিতিকে সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই নৃগৃহীত জনগোষ্টির পক্ষে তার সরব অবস্থান ঘোষনা করছে। তার অবিচল দাড়িয়ে থাকা যেন অবহেলিত এই আদীবাসীদের সুতীব্র অনুপ্রেরনা জাগাচ্ছে দুপ্ত বলয়ে জেগে উঠার, সপ্রতিভ প্রতিবাদ করার, সম্মিলিত প্রয়াসে। দেবালয়ের অক্ষত এই মূর্তিগুলো যেন অসহায়দের পক্ষে অসীম-শক্তির শক্ত অবস্থানকে আবারও স্মরন করিয়ে দিচ্ছে আমাদেরকে প্রতিটা মুহুর্তে।
কোনঠাসা এই পাহাড়ী আদীবাসীদের উপর এই রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সরকারের আমলে সুবিধাবঞ্চিত এই জাতি চরম অবমাননার শিকার হয়েছে। শরনার্থী হিসেবে ট্রিটেট অনেক পাহাড়ীরা প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে আগ্রাসী রাষ্ট্রজাতির স্বোচ্ছাকল্পে। দেশের মুলধারার সুবিধাগুলো গ্রহন করা থেকে তাদেরকে অপয়া করে রাখা হয়েছে প্রথম থেকেই। দিঘীনালার বাঘাইছড়িতে ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাস থেকেই তাদের উপর নির্যাতন শুরু যা এখন পর্যন্ত পূর্ন শক্তিতে বহাল রাখা হয়েছে। এর বদৌলতে কয়েকশত উপজাতি প্রান হারিয়েছে, প্রচুর আদি তীর্থস্থান, অনেক পুরাকীর্তির বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কালের অতলে। সাম্প্রতিক কালের বাঘাইছড়ি, রাঙামাটির ঘটনাপ্রবাহ তারই ধারাবাহিক ক্রম। ক্রমান্বয়ে তাদের নিজ ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে কতিপয় দখলদারদের যোগসাজশে যা কতটা অমানবিক তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। খাগড়াছড়ি শহরে ১৪৪ ধারা জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন, জরিপের জের ধরে দখলদারীদের সাথে একাত্মতা এই নিরিবিলি জীবনে অভ্যস্থ কোনঠাসা আদীবাসীদের উপর ভারসাম্যহীন লড়াই রীতিমত তীব্র ঘৃনার উদ্রেক করায় আমাদের স্বজাতির উপর। বর্তমান বাঙ্গালীজাতির একজন অংশীদার হয়ে হিংস্রতার রূপ দেখে রক্ত ঘৃনায় গরম হয়ে উঠে ক্ষনে ক্ষনে।
অক্ষমতার লাগামহীন ঘোড়া আমাদের বাঙ্গালীদের টুটি চেপে ধরে নিয়ন্ত্রন করে ইচ্ছেমত। আমরা অক্ষম, আমরা সীমাবদ্ধতার অজুহাত দেখাই, বেশিরভাগ সময় আমরা স্বেচ্ছায় প্রতিবাদ করি না। আমরা কথা বলতে পারিনা, কারন আমরা কথা বলতে চাই না। আমরা নিরিবিলি, নিভের্জালভাবে জীবন অতিবাহিত করতে চাই। রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধাবাদী দখলদাররা নির্বিচারে এই অসহায় মানুষগুলোর উপর আক্রমন চালাচ্ছে, আমরা কথা বলছি না। তাদের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নিশ্চিন্হ করা হচ্ছে, আমরা কথা বলি না। দেশের মুল ধারার সংস্কৃতি এই স্বকীয়, স্বতন্ত্র বৈশিষ্টমন্ডলিত কলা-সংস্কৃতিকে প্রতিনিয়ত ধর্ষন করে যাচ্ছে, আমরা কথা বলি না। দেশের সুবিধাবাদী গুটিকয়েক মানুষেরা প্রতিনিয়ত এইসব আদিবাসীদের অস্তিত্বকে বলাৎকার করে যাচ্ছে, আমরা কথা বলি না। দেশের তথাকথিত সুশীলরাও তাদের কলম দিয়ে পাহাড়ীদের মিথ্যা দোষ ধরায় ব্যস্ত, আমরা তাতেও কথা বলি না। ছোট ছোট নিষ্পাপ পাহাড়ী বাচ্চারা আমাদের দিকে তীব্র ঘৃনাভরে তাকিয়ে আছে। আমরা কথা বলি না। চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়, আমরা কথা বলি না। বঙ্গবন্ধুর ৩৪ বছরের লাশের ভারটি একটি কালো অধ্যাদেশের মাধ্যমে কোমায় রাখা হয়, আমরা কথা বলি না।
আমরা কানেও শুনি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রির আপনি ডান কানে কি এখনও কম শুনেন? আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি খুনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেন, আপনি তা শুনেন না। রাজাকারেরা দেশে কোন রাজাকার নেই বলে সর্বত্র বুক চিতিয়ে বলে বেড়ায়, আপনি শোনেন না। কদিন পর পর ঢাকার অসহায় বস্তিবাসীদের ঘরদোর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, আপনি তাদের আর্তচিৎকার শোনেন না। সমানে দেশের মেধাবী তরুনদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, আপনি তাদের আর্তনাদ শোনেন না। সেখানে দুরের পাহাড়গুলো ডিঙ্গিয়ে আদিবাসী পাহাড়ীদের হাহাকার আপনার কানে আসবে না এ আর আশ্চর্য কি!
আমরা যে শুধু কথা বলি না তা না, আমরা চোখেও দেখি না। রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তিগুলো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে তাদের অপকর্মগুলো করে যাচ্ছে, আমারা দেখি না। নাইকো, অক্সিডেন্টাল নামের বাঘা বাঘা কোম্পানিগুলো দেশের বিপুল অর্থের অপচয় করে আমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে গেল, আমরা দেখি না। গুটিকয়েক লোক একে অপরের সাথে দলাদলি, রেশারেশিতে সংসদের প্রচুর অর্থের অপচয় করে যাচ্ছে, আমরা দেখি না। স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন বিশেষ জাতীয় দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের পদকবিতরন অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে। পাহাড়ি জনগোষ্টীর ধীরে ধীরে কোনঠাসা করে ফেলা হচ্ছে, আমরা তা দেখেও দেখি না।
সম্প্রতি বাঘাইছড়ির ঘটনায় দুজন পাহাড়ির লাশ উদ্ধার হয়েছে, পাঁচ থেকে আটজন মারা গেছে বলে বলা হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে আরও একজন বাঙালির মৃত্যুর খবর এসেছে। আগুনে কেবল শত শত পাহাড়ির বাড়িঘরই ছাই হয়ে যায়নি, পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে শান্তির যে জলপাই চারাটি লাগানো হয়েছিল, আঁচ লেগেছে তারও গায়ে। তাই চরম উদ্বেগ কেবল পাহাড়ি-বাঙালির জান-মাল নিয়েই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। এ দেশের শেকড়ের সঙ্গে আদিবাসীদের সম্পর্ক। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর সরকারবিরোধী যে অংশ রয়েছে, তাদের অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের ফলে এ ধরনের সংঘর্ষ বেধেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এই সরকারবিরোধী দলটি এভাবে লায় পেয়ে পেয়ে পুরো দেশকেই একসময় অন্ধকারের অতল গহবরে নিয়ে যাবে, যখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না।
এইসব সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো মোকাবিলায় আমাদেরকে সরব ভুমিকা পালন করতে হবে। অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে হবে। আড়গোড় ভেঙ্গে সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুবিবেচক ভুমিকা পালন করতে হবে। নইলে আমাদের বাঙালী ইতিহাসে এই লজ্জাজনক অপকর্মের দায় আমাদেরই ঘাড়ে বয়ে নিতে হবে। এ দায় থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন